
অঢেল সম্পদের গুরুত্ব যে বুঝে না, সে কখনো তা গ্রহণ করার জন্য এগিয়ে যাবে না। যে ব্যক্তি ধনভান্ডারের মূল্য অনুধাবন করে না, সে কখনো তার হিফাজত করতে পারবে না। তাই এই কথাগুলোর শিরোনাম দেওয়া হয়েছে কেন সময় দেওয়া হয়েছে? এই নামে।
অনেক মানুষ আছে এমন, যারা সময়ের গুরুত্বকে আস্বীকার করে না , বরং ভালোভাবেই সময়ের গুরুত্বকে অনুধাবন করে। কিন্তু তাদের বাস্তবিক অবস্থা এর সম্পূর্ন বিপরীত।নিশ্চয় এটা তাদের অজ্ঞতার পরিচয় বহন করে। ইবনুল কাইয়িম (রা) বলেন, অজ্ঞতা দুই ধরনের।
(১)হকের ব্যাপারে কোনো ধারণাই না থাকা।
(২) ধারণা থাকলেও হকের চাহিদা অনুযায়ী আমল না করা। উভয়টি শাব্দিক পারিভাষিক, বাস্তবিক ও শরয়ি দৃষ্টিকোণ থেকে অজ্ঞতা হিসেবেই বিবেচিত।এই আলোচনার উদ্দেশ্য হলো, তোমার মাঝে যেন উভয় প্রকার অজ্ঞতার কোনোটির অস্তিত্ব না থাকে। লেখাটি পড়া শেষে তোমার কাছে আমার প্রত্যাশা থাকবে, এখান থেকে যা কিছু শিখবে,তা বাস্তবে আমলে পরিণত করবে, প্রতিটি সময়কে গণিমত মনে করবে এবং দৈনন্দিনের রুটিনকে নেক আমল দ্বারা ভরপুর করে তুলবে।
(১) অতীত কখনো ফিরে আসে না
একেকটি দিন অতীত হয়ে যায়। অতিবাহিত হয়ে যায় প্রতিটি ঘন্টা। প্রতিটি মুহূর্ত চলে যায় আপন গতিতে। যেগুলোকে আর কখনো ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়
এবং সম্ভব নয় এর ক্ষতিপূরণ দেওয়াও। আচ্ছা বলো তো,কখনো কি পেরেছে ঘড়ির কাঁটাকে পেছনে ফিরিয়ে আনতে, যাতে তোমার আতিবাহিত খারাপ সময়কে ভালো দ্বারা পূর্ণ নিতে পারো?
হাসান বসরি (র) এর অসিয়ত শোনো! আদম-সন্তানের অতিবাহিত প্রতিটি দিন অতীত হতে থাকে আর বলতে থাকে, হে আদম-সন্তান, আমি নতুন একটি দিন, আজ তোমার প্রতিটি কৃতকর্মের সাক্ষী আমি।তোমার কাছ থেকে চলে গেলে আর কখনো ফিরে আসব না। তাই পরকালের জন্য সাধ্যমতো যতটুকু পারো আমল করে নাও। তোমার ইচ্ছে হলে বিলম্বও করতে পারো। তবে মনে রেখো, আমি তোমার কাছে আর কখনো ফিরে আসব না
সময়ের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যেগুলো অন্য কিছুর মাঝে নেই। এর প্রত্যেকটিই তোমাকে সময়ের মহামূল্য
ও যত্নের কথা বুঝিয়ে দেবে। যেমন :
(*) সময়কে সঞ্চয় বা সংরক্ষণ করে রাখা যায় না। তাই যে মুহূর্তটিকে তুমি ব্যবহার করতে পারছ না, তা কিন্তু চলে যায়। কিয়ামত পর্যন্ত কখনো তা ফিরে আসবে না
(*) সময়কে কোনো কিছুর সাথে বিনিময় করা যায় না। কারণ সময় সবকিছুর চাইতে বেশি মূল্যবান।
(*) সময় হলো জীবনের একমাত্র উপাদান। কেননা, জীবন তো কতগুলো বছর মাসের সমষ্টি। যেই মাস ও বছরগুলো একেকটি মুহূর্ত ও একেকটি ঘন্টা থেকে সৃষ্টি।
(*) সময়কে পরিমাপ করা যায় না, অনুধাবন করা যায় না এবং স্পর্শও করা যায় না। তাই প্রতিটি কাজের জন্য সময় পাএতুল্য হওয়া সও্বেও তুমি সময়কে আটকে৷ রাখতে পারবে না।
(*) কেউ নিজের ইচ্ছায় সময়কে দ্রুত বা ধীর গতিতে অতিবাহিত করতে পারবে না এবং থামিয়েও রাখতে পারবে না।
(২) হিসাবের পালা
সময় অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর যদি কোনো চিহ্ন রেখে না যেত?! কেননা, হাশরের ময়দানে বিচারের কাঠগড়ায় মানুষকে প্রতিটি মুহূর্ত সম্পর্কে জিজ্ঞেসা করা হবে। যখন মানুষ আপন প্রতিপালকের সামনে দণ্ডায়মান হবে, তখন তিনি বান্দার বয়স ও একেকটি সময়ের তিল তিল হিসাব গ্রহণ করবেন। তিনি জিজ্ঞাসা করবেন কীভাবে তা ব্যয় করেছ? কোথায় ব্যয় করেছ? কোথায় ব্যস্ত রেখেছ এবং কী কাজ দ্বারা তাকে পূর্ণ করেছ?
নবি কারিম রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, কিয়ামতের দিন কোনো বান্দার কদম নড়বে না, যতক্ষণ না তাকে চারটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে। তার জীবন সস্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে, কোথায় তা ব্যয় করেছে? তার যৌবন সস্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে, কোথায় তা ক্ষয় করেছে? (সহিহ)
কবি বলেন :
আজ আমি মনের চাহিদামতো যাচ্ছাতাই করে যাচ্ছি অথচ আগামী কাল আমি মরে যাব এবং আমলনামা বন্ধ হয়ে যাবে।
হায়! আমার আবস্থানের কারণে নিজের জন্য লজ্জা হচ্ছে, আমাকে আমার পদস্খলনের কারণ সস্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।
হায় আফসোস! হায় আফসোস! যুগ যুগ ধরে খিয়ানতই করেছি । আমার প্রতি অর্পিত আমানতকে রক্ষা করিনি।
(৩) সময় একটি গোপনীয় নিয়ামত
যদিও সময় এমন কোনো অর্থ বা বস্তু নয়, যা মানুষ দোকান বা বাজার বিনিময় করে থাকে, তবুও সময়কে সবচেয়ে দামি ও গুরুত্বপূর্ণ ধনভান্ডার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যা দেখা যায় না। অত্যন্ত গোপনীয়। যদি মানুষ এই ধনভান্ডার চোখে দেখত এবং এর মূল অনুধাবন করত, তাহলে তা অর্জন করার জন্য পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হতো। এ ছাড়াও স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর হাদিস থেকে স্পষ্ট বুঝে আসে যে, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে যতগুলো নিয়ামত দিয়ে থাকেন, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠ নিয়ামত হলো সময়। সময়ের প্রতি এত গুরুত্ব দেওয়া সও্বেও মানুষ এ ব্যাপারে উদাসীন। ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন :
দুটি নিয়ামতের ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষ প্রতারিত। তা হচ্ছে সুস্থতা ও অবসর।
হাদিস: রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, খুবই অল্প সংখ্যক মানুষই সময়ের গুরুত্ব আনুধাবন করে। সুস্থবস্হয় প্রায় সবাই ভোগবিলাসে লিপ্ত হয়ে পড়ে। জীবনকে উপভোগ করার মাঝে ব্যস্ত থাকে। আবার অবসরতা পেলেও অনেক ভোগবিলাসে লিপ্ত হয়ে যায়। অনেকের অবস্থা তো এমন যে, তারা বার্ধক্যে উপনীত হবার পরও অবসরতার দ্বারা ধোঁকাগ্রস্ত হয়। যখন কেউ এই দুটি নিয়ামতের একত্রে পায় এবং এগুলোর সঠিক ব্যবহার না করে আল্লাহর আনুগত্যের ব্যাপারে অলসতা করে, তখনই তাকে ধোঁকাগ্রস্ত বলে আখ্যায়িত করা হয়। আর ———— হলো, কোনো পণ্যকে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে ক্রয় করা অথবা নির্ধারিত মূল্যের চেয়েও কম মূল্যে বিক্রি করা।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) একজন পরিপূর্ণ শরয়ি দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষকে এমন ব্যবসার সাথে তুলনা দিয়েছেন, যেই ব্যবসার মধ্যে মূলধন রয়েছে। যেকোনো মানুষ মূলধন খাটিয়ে ব্যবসা শুরু করলে তা থেকে সে লাভের আশা করে এবং মূলধনকেও টিকিয়ে রাখতে চায়। আর এ জন্য যার সাথে সে ব্যবসায়িক লেনদেন করে, তার আমানতের ব্যাপারে সে খুবই সতার্ক থাকে। তার প্রতি খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে, যাতে তাকে কেউ ধোঁকা দিতে না পারে। কারণ কেউ যদি তাকে ধোঁকা দিয়েই ফেলে, তাহলে তো সে নিশ্চিত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই উদাহরণটির বাস্তব নমুনা এই যে, দুনিয়া হলো আখিরাতের শস্যক্ষেত। আর সুস্থতা ও অবসরতা হলো মূলধন। কিন্তু এই দুই মূলধনের লভ্যাংশ বাহ্যিকভাবে দেখা যায় না। কেবল আখিরাতের এদের লাভক্ষতি দেখা যাবে। তাই যে ব্যক্তি তার অবসরতা ও সুস্থতাকে আল্লাহর আনুগত্যের ব্যয় করেছে, আগামী দিন (আখিরাতে) সে-ই হবে প্রকৃত লাভবান। আর যে এ দুটি নিয়ামতকে আল্লাহর অবাধ্যতায় ব্যয় করেছে,দুনিয়া ও আখিরাতে সে-ই হলো প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ও ধোঁকাগ্রস্ত। আরেকটি কথা না বললে নয়, এই দুটি নিয়ামত খুব দ্রুতই চলে যায়। কেননা, অবসরতার পরে ব্যস্ততা এবং সুস্থতার পরে অসুস্থতা চলে আসে।
(আমরা সময়ের খুব মুখাপেক্ষী। অথচ এগুলোর সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে দুনিয়া -আখিরাতের কল্যাণ অর্জন করল না, সে-ই প্রকৃত হতভাগা। আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদের তাঁর প্রদও নিয়ামত পেয়ে ধোঁকাগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করেন এবং আমাদের প্রতি তাঁর ইহসানের মূল্য বোঝার তাওফিক দান করেন। আমিন।
(সময়ের সঠিক ব্যবহার বই থেকে)